25 September 2012 - 0 comments

আমার জীবন খাতার প্রতি পাতায় 8

তখন কলেজে আমার ১ম বছর চলছে। সাইন্স নিয়ে পড়ছি, ফিজিক্সে অনার্স। বেশ কেটে যেত কলেজের দিনগুলো বন্ধুবান্ধবের সাথে গেঁজিয়ে, আড্ডা মেরে। সুন্দর তো ছিলামই, তাই সবার চোখের মণি ছিলাম আমি। যেকোনো ব্যাপারে আমাকে না জিজ্ঞেস করে বন্ধুরা কোন ডিসিশন নিতো না। আমিও এই অ্যাটেনশন খুব উপভোগ করতাম। মেয়েরাই ছিল আমার বেশি বন্ধু আর হবারই কথা কারন আমাদের কলেজ ছিল শুধু মেয়েদের।

পথ চলতে চলতে দু একটা যে মন্তব্য শুনতাম না তা নয়। ছুটির সময় কলেজের বাইরে ছেলেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার যেন মনে হতো আমাদের গ্রুপটার দিকেই ওদের নজর ছিল বেশি।

আমরা হি হি হাসি আর অনর্গল কথা বলতে বলতে পথ চলতাম বেশ কিছুটা দূর। তারপর গিয়ে যে যার মত বাস ধরে বাড়ীর দিকে রওনা দিতাম। আমার সাথে তিন চারটে বন্ধু একসাথে বাসে আসতো। ওরা থাকতো আমার পাড়া থেকে একটু দূরে।

একদিন এইভাবে কথা আর হাসতে হাসতে আমরা আসছি। হঠাৎ একটা ছেলের মন্তব্য কানে ভেসে এলো। একগুচ্ছ ছেলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের যাওয়ার পথে। ওদেরই মধ্যে কেউ একজন কথাটা বলেছিল। বলেছিল আরেকজনকে, ‘হ্যাঁরে বলতে পারিস মেয়েরা এতো বেশি কথা বলে আর হাসে কি করে?’

যে বলেছিল তাকে দেখিনি আর যাকে বলেছিল তাকেও দেখিনি। কিন্তু তার উত্তর কানে এসেছিল। সে উত্তর দিয়েছিল, ‘ এটা জানিস না, ওদের দুটো মুখ আছে বলে ওরা বেশি কথা বলে, বেশি হাসে।‘

আমাদের লজ্জায় মুখ লাল হয়েগেছিল। বুঝেছিলাম দুটো মুখ বলতে ছেলেটা কি বুঝিয়েছিল। কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় নি। ছেলেগুলো হাসছিল কেমন উন্মত্তের মত। আমরা কোনরকমে পার হয়ে এসেছিলাম ওদের। অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারি নি। অনেকটা পথ চলে আসার পর আমি বলেছিলাম, ‘ইসস, দেখলি কি অসভ্য ছেলেগুলো? কি ভাবে বলল কথাটা?’

অনিমা বলে একজন বলল, ‘কিন্তু আমরা কোন উত্তর দিতে পারলাম না। কি কাণ্ড বলতো?’

আমি জবাব দিলাম, ‘পায়েলকে বলেছে। এতো সহজে পার পেয়ে যাবে ভেবেছিস? ঠিক জবাব দেবো।‘

আরেকজন শিল্পা বলল, ‘কিন্তু কি বলবি বল না?’

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কি বলছিস কি বলবি? বললে তো তখনই বলে দিতে পারতাম। একটু ভাবতে দে।‘

চলে এলাম ঘরে। কিন্তু সারাক্ষন মনটা খুচখুচ করতে লাগলো জবাব দিতে পারি নি বলে। কি বলবো, কি জবাব দেবো এই করতে করতে আবার কলেজে এলাম। সবাই মিলে হা হা করে ঘিরে ধরল কাল যারা যারা ছিল। অনিমা বলল, ‘হ্যাঁরে কিছু জবাব দেবার মত পেয়েছিস?’

আমি না বলতে পারলাম না। ওরা আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করে। আমি হেরে যেতে পারি এটা ওরা কোনদিন ভাবতে পারে না। তাই ‘না কোন জবাব খুঁজে পাই নি’ এটা বলতে সঙ্কোচ হোল বলতে। আমি মুখ টিপে একটু হাসলাম। এতেই ওরা খুশি। ওরা জেনে গেল যে জবাব তৈরি।

বিকেলে ক্লাস শেষে আমরা বেড়িয়ে এলাম বাইরে। আমার বুকটা ধুকধুক করছে কি উত্তর করবো ছেলেগুলোকে। শান্ত হলাম যখন দেখলাম ছেলেদের ভিড়টা আজ আর নেই। যাক বাবা, খুব বেঁচে গেছি। ভাগ্যিস ওরা নেই। থাকলে খুব মুশকিলে পরতে হতো।

আমরা হাঁটছি, আজ আর আমাদের মধ্যে ওই হাসি আর গরগর করে কথা নেই। একটু চুপচাপই আমরা। বলা যায় না আবার কি কমেন্ট আসে। যদিও আজ ছেলেদের গ্যাঙটা নেই দাঁড়িয়ে। আমরা চলতে চলতে আমাদের পাশ দিয়ে দুটো ছেলে হনহন করে হেঁটে পার হয়ে যেতেই শিল্পা বলে উঠলো ফিসফিস করে, ‘ওই দ্যাখ ওই দুটো ছেলে যাচ্ছে। ওরাই কাল কমেন্ট দিয়েছিল।‘

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর ইউ শিওর যে ওরাই বলেছিল?’

শিল্পা বলল, ‘হান্ড্রেড পারশেন্ট শিওর ওরাই।‘

আমি বললাম, ‘চল একটু তাড়াতাড়ি হাঁটি।‘ বলে হাঁটতে লাগলাম তাড়াতাড়ি। মেয়েগুলো আমার সাথে জোরে হাঁটতে লাগলো। একটু পরেই ওদের ধরে ফেললাম মানে ছেলেগুলোকে। আমার জবাব পেয়ে গেছি। ওদের ঠিক পিছনে এসে পথচারীদের কান বাঁচিয়ে অথচ ছেলেগুলো শুনতে পায় এমন জোরে বললাম, ‘হ্যাঁরে, তোরা বলতে পারিস ছেলেরা এতো জোরে হাঁটে কি করে?’

অনিমা উত্তর দিল, ‘নারে, কেন বলতো?’

আমি ওদের মানে ছেলেদের শুনিয়ে বললাম, ‘ওদের তিনটে পা আছে বলে।‘

ছেলেগুলো কেটে গেল পাশের একটা গলিতে। শিল্পা উল্লসিত হয়ে আমাকে চকাম করে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘সত্যি গুরু, তোমার জবাব নেই। কি উত্তর।‘ সবাই মিলে হাসতে হাসতে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। মনের থেকে একটা বোঝ নেমে গেল যুতসই জবাব দিতে পেরেছি বলে। ছেলেগুলো পরে আর ডিস্টার্ব করতো না।

আমরা সবাই ঠিক করলাম শান্তিনিকেতন ট্যুরে যাবো। প্রায় পঁচিশ জনের মত। প্রফেসরকে বললাম, উনি অনুমতি দিলেন। একজনকে আমাদের তোলা টাকা রাখতে দিলাম। আমি লিডার। এটা বলাবাহুল্য। আমি না হতে চাইলেও কেউ শুনত না। তাই আমার নাম ওঠাতে আর তর্ক করি নি। শান্তিনিকেতনে এসে শুনলাম ডরমিটরিতে মাত্র ২২ জন থাকতে পারবে। বাকি তিনজনকে একটা ৪বেডের রুমে থাকতে হবে।

যেহেতু আমি লিডার সুতরাং বাকি সবাই বলল, ‘পায়েল তুই অনিমা আর শিল্পা ওই রুমে থাক। আমরা সবাই ডরমিটরিতে থাকবো।‘

না না করেও কেউ শুনল না। একসাথে থাকার মজাই আলাদা। হুল্লোড় করে সময় কখন কেটে যাবে কেউ জানতেও পারবো না। সেটা মিস হবে শিওর। আমি অনেক চেষ্টা করলাম অন্য তিনজনকে ওই ঘরে পাঠাবার জন্য। কিন্তু কেউ শুনতেই চাইল না। বাধ্য হয়ে আমি শিল্পা আর অনিমা তিনজনে নিজেদের ব্যাগ ওইঘরে ঢোকাতে বাধ্য হলাম। বিকেলে সবাই মিলে শান্তিনিকেতনের সামনে ঘুরছি। খেয়াল করি নি মাটির উপর করে রাখা একটা গর্তকে। পরবি তো পর আমারই পা ওই গর্তে পরে মচকে গেল। কি দারুন ব্যাথা! সবাই মিলে মালিশ করাতেও ব্যাথা গেল না।

কোনরকমে রাত কাটিয়ে সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন পা নাড়িয়ে বুঝতে পারলাম ব্যাথা তখনো আছে। মাটিতে পা ফেলতে গিয়ে দেখলাম চাপ দিলেই লাগছে। ভয় হতে লাগলো যে সবার সাথে বেড়তে পারবো কিনা। কাউকে কিছু বলি নি। কোনরকমে স্নান সেরে কাপড় জামা পরে নিলাম। মধ্যে শিল্পা একবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে পায়ের ব্যাথা কেমন আছে?’

আমি মুখে কনফিডেন্স দেখিয়ে বললাম, ‘না না, আমি ঠিক আছি।‘

ও আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের সাথে যেতে পারবি তো?’

আমি আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে বললাম, ‘কেন নয়? এই দ্যাখ আমি কেমন ফিট।‘ বলে একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে গিয়ে আবার চোট লাগিয়ে ফেললাম। পাটা ধরে বসে পড়লাম আমি। নাহ্*, পা আমাকে যেতে দেবে না দেখছি।

শিল্পা দৌড়ে এসে আমাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। বলল, ‘তুই কি রে। অনর্থক রিক্স নিচ্ছিলি। যদি বেড়ে যায় তো এখান থেকে যেতেই পারবি না।‘

আমি পায়ে হাত বুলতে বুলতে বললাম, ‘তোরা সব একসাথে আনন্দ করবি আর আমি বসে থাকবো? তা হয় নাকি?’

শিল্পা জবাব দিলো, ‘আরে আজ তুই সুস্থ হয়ে উঠলে কাল আবার বেড়তে পারবি। আর আজ যদি ব্যাথা বেড়ে যায় তাহলে তোর তো ট্যুরের আনন্দই বেকার হয়ে যাবে। একদিনের জন্য নিজেকে সামলাতে পারছিস না? ঠিক আছে তাহলে। তোর সাথে আমিও থেকে যাচ্ছি। তাহলে তো হোল?’

আমি কিছু বলার আগেই সবাই হইহই করে ঘরে চলে এলো। একসাথে সবাই বলতে লাগলো, ‘চল চল, আমরা তৈরি। বেড়িয়ে পরি চল।‘

শিল্পা ধমক দিয়ে বলল, ‘তোরা একটু থামবি, চুপ করবি? পায়েলের পায়ে চোট, তারদিকে তোদের কোন নজর নেই। সবাই আছিস নিজের আনন্দে।‘

সবাই এক লহমায় চুপ করে গেল। অনিমা এগিয়ে এসে বলল, ‘কিরে সকালেই তো তোকে দেখলাম দিব্যি হাঁটছিস। কি হোল আবার?’

শিল্পা জবাব দিলো, ‘ও হাঁটছিল আমাদের দেখানোর জন্য। ওর ব্যথা ওই একইরকম আছে।‘

আমি বললাম, ‘তোরা যা ঘুরে আয়, আনন্দ করে আয়। আমি আজ একটু রেস্ট নিই কাল একসাথে বেরবো।‘

শিল্পা জিদ করতে লাগলো আমার সাথে থাকবার জন্য। ও আমাকে একা ছেড়ে দিতে চায় না। আমি জোর করে ওকে গ্রুপের সাথে পাঠালাম। আমার জন্য একজনের আনন্দ নষ্ট হবে তা কি আমি হতে দিতে পারি

১৮


ওখানকার কেয়ারটেকার একজন বয়স্ক মানুষ। সুধীর কাকু। বয়স প্রায় ৫৫/৫৬ হবে। ওনাকে ডেকে অনিমা বলল, ‘কাকু, পায়েলের কাল পা মচকে গেছে। এখনো ব্যথা আছে। আপনি একটু নজর রাখবেন ওর উপর? ওর যাতে কোন অসুবিধে না হয়?’

সুধীর কাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে একি কথা মা? আমি নজর রাখবো না তো কে রাখবে? তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুরে এসো। আমি খেয়াল রাখবো।‘

সন্তুষ্ট হয়ে সবাই চলে গেল। সারা জায়গাটা কেমন নিশ্তব্দতায় ভরে গেল। হঠাৎ করে পাখির গুঞ্জন থেমে গেলে যেমন হয়। সুধীর কাকু ওদের ছেড়ে এসে আবার আমার ঘরে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি করে হোল মা পায়ে ব্যথা?’

আমি বললাম, ‘কাল গর্তে পা পরে মচকে গেছে। সারেনি ব্যথাটা।‘

কাকু উত্তর দিলেন, ‘দাঁড়াও, এখানে একটা ভালো ডাক্তার আছে। তাকে ডেকে নিয়ে আসি। আজই তোমার ব্যথা সারিয়ে দেবেন। কাল তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে পারবে।‘

প্রায় আধঘণ্টা পরে কাকু একজন ডাক্তার নিয়ে ঢুকলেন। উনি আমার পা টিপে ভালো করে দেখে বললেন, ‘চিন্তার কোন কারন নেই। পেশির ব্যথা। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খাইয়ে দেবেন। আর পারলে একটু রসুন তেল দিয়ে মালিশ করলে আরও তাড়াতাড়ি উপকার পাবে।‘

সুধীর কাকু আমাকে ওষুধ খাইয়ে বললেন, ‘মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে প্রায় তিন চার ঘণ্টা লাগবে। বাইরে অনুজ রইল। ওকে বলে দিলাম থেকে থেকে যেন তোমার খোঁজ নেয়। আর তোমার নাস্তা ও এনে দেবে বলে দিয়েছি। পারবে তো মা একটু একা থাকতে?’

আমি বললাম, ‘আপনার কোন চিন্তা নেই কাকু। আপনি নিশ্চিন্তে যান। অনুজ তো রইল। দরকার পরলে আমি ডেকে নেব।‘

কাকু বেড়িয়ে গেলেন। আমি দেখলাম আর শাড়ি পরে রেখে কি হবে। খুলেই নিই। যখন বেরতেই পারবো না। কোনরকমে উঠে দরজা বন্ধ করে শাড়ি শায়া খুলে ভাঁজ করে রেখে দিলাম। গায়ে চরিয়ে নিলাম একটা নাইটি। নিচে ব্রা আর প্যান্টি রইল। আবার এসে শুয়ে পড়লাম দরজাটা খুলে একটু ভেজিয়ে দিয়ে। কি যেন নাম ছেলেটার হ্যাঁ, অনুজ আবার দেখতে আসতে পারে। আমার কপালে ভাঁজ পড়লো, কাল থেকে এই অনুজকে তো দেখি নি। হঠাৎ এ আবার কে উদয় হোল। কাকু বলে গেছে, ওনারই চেনাজানা কেউ হবে হয়তো। নাহলে ওর উপর সমস্ত কিছু ছেড়ে যাবে কেন? কিন্তু দেখলাম না কেন, ছিল না? হয়তো ছিল, কাল সবার সাথে আনন্দ করতে গিয়ে আর খেয়াল করি নি।

পেটটা কেমন খালি খালি লাগছে। খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে এক কাপ চা ছাড়া আর কিছু পেটে যায় নি। বাকি সবাই খেয়ে দেয়ে বেড়িয়েছে নিশ্চয়ই। আমি ডাকতে যাবো অনুজকে, দরজায় আওয়াজ পেলাম খটখট। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছেলে হাফ প্যান্ট আর গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার চোখ ওর দিকে পরতেই ছেলেটা বলল, ‘আসবো দিদিমনি?’

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ও চাপা পায়ে ভিতরে ঢুকল। বয়স আমারই মত হবে কিংবা আমার থেকে হয়তো ছোট। সারা মুখটায় একটা সরলতা ছড়িয়ে আছে। গোঁফের রেখা ঠোঁটের উপর খুব মিহি। নেই বললেই চলে। হাত পাগুলো খুব একটা পেশি বহুল নয়। পাতলা বলাই ভালো। সামনে এসে হাত দুটো জড়ো করে দাঁড়িয়ে রইল।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?’

অনুজ বলল, ‘হ্যাঁ দিদিমনি। আপনি কি এখন নাস্তা করবেন?’

আবার খিদেটা পেটে যেন ছোবল মারল। আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব খিদে পেয়েছে।‘

ছেলেটা ঘুরে গিয়ে বলল, ‘এক্ষুনি নিয়ে আসছি আমি।‘

আমি ওকে দাঁড় করালাম, বললাম, ‘এই শোন, তোমার নামটা কি বেশ?’

ছেলেটা জড়তার সাথে জবাব দিলো, ‘আজ্ঞে, অনুজ। সবাই আমাকে অনুজ বলে।‘

আমি আর কিছু না বলে বললাম, ‘ঠিক আছে, নিয়ে এসো নাস্তা। কি আছে নাস্তায়?’

ছেলেটা হাত কচলিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে দিদিমনি, আলুর পরোটা আর সাথে আঁচার আর দই। খাবেন তো?’

মুখের ভিতর জিভটা আলুর পরোটার নাম শুনেই সিক্ত হয়ে উঠলো। বলে ফেললাম, ‘যাও, প্লিস তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।‘

কিছুক্ষন পর অনুজ নাস্তা নিয়ে এলো। এধার ওধার দেখতে লাগলো কোথায় রাখবে হাতের সবকিছু। আমি বিছানার উপর দেখিয়ে বললাম, ‘এইখানে দাও। এইখানেই খেয়ে নেব আমি। কোন অসুবিধে নেই তো?’

অনুজ একটু হেসে বলল, ‘না আমার কোন অসুবিধে নেই। আপনি খেতে পারেন বিছানায়।‘ খুব মিষ্টি হাসি অনুজের, আমার ভালো লাগলো।

আমি উঠে বসতে অনুজ আমার কোলের সামনে থালা সাথে আঁচার আর দইয়ের বাটি রাখল। অন্য হাতে ধরা জ্বলে গ্লাস একটু দূরে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিলো। ও বেড়িয়ে যাচ্ছিল আমি ডাকলাম, ‘এই তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

অনুজ আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘কোন দরকার আছে দিদিমনি?’

আমি বললাম, ‘না দরকার তো নেই। কিন্তু আমি একা। তুমি বস, তোমার সাথে গল্প করি।‘

অনুজ এধার ওধার চেয়ে বসার কিছু দেখতে না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইল আমার সামনে। অনুজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। পরিস্কার রঙ, গেঞ্জি আর প্যান্ট সব ধোপদুরস্ত। না, অন্যদের মত নয়। আমি ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিগো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বস।‘ ওর ইতস্ততা দেখে বললাম, ‘আরে এই বিছানার উপর বস। নাহলে আর বসবে কোথায়?’

অনুজ গরিমসি করে বিছানার একধারে বসল। আমি পরোটার একটুকরো মুখে দিলাম সাথে একটু আঁচার আর দই। আহ, খুব স্বাদিস্ট। মুখে দারুন লাগছে। অনুজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও অন্যদিকে চেয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি টিফিন করেছ?’

অনুজ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ দিদিমনি। সকাল বেলাতেই টিফিন হয়ে গেছে। আমরা সকালবেলাতে টিফিন করে নিই।‘

জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাড়ীতে কে কে আছে তোমার?’

অনুজ জবাব দিল, ‘মা আছেন। বাবা ছোটবেলায় মারা গেছেন আর এক দিদি আছেন।‘

আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, ‘ইসস, অ্যাই অ্যাম সরি। তো কিভাবে চলে তোমাদের?’

অনুজ উত্তর করলো, ‘এই এইখানে আমি যা পাই আর মা বাড়ী বাড়ী কাজ করেন। আমাদের চলে যায়।‘

নাহ, টপিক অন্যদিকে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে থেকে আছো এখানে?’

ও বলল, ‘জন্মের পর থেকেই। বাবা এখানেই কাজ করতেন। সুধীর কাকু খুব ভালো। বাবা মারা যাবার সময় নাকি বাবাকে কাকু বলেছিলেন, তুই কোন চিন্তা করিস না। ছেলে বড় হলেই আমার এখানে কাজে নিয়ে নেব। আর ততদিন তোর সংসার আমি দেখব। আমার বয়স ১২ হবার পর থেকে আমি এখানে কাজ করি। কাকু খুব বিশ্বাস করে আমাকে। আমিও কাকুকে খুব ভালোবাসি।‘

সুধীর কাকুর উপর আমার মন ভক্তিতে ভরে উঠলো। এই জগতে এই রকম লোক আর কজন আছে যে এইভাবে হেল্প করতে পারে। সবারই লোভ বেশি, চাহিদা বেশি। এই কাকুদের মত লোকেদের দেখলে মনে হয় এই পৃথিবী এখনো সুন্দর আছে, এখনো এখানে পাখি ডাকে, ফুল ফোটে, সকাল হয় রাত আসে, সূর্য ওঠে দিনে আর রাতে চাঁদ। মনে হয় এখনো এখানে সবুজের রাজত্ব আছে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই ঘন সবুজের ছোঁওয়া বোঝা যায়, সবুজের গন্ধ নাকে এসে লাগে। কাকু তোমরা বেঁচে থেকো। তোমরা না থাকলে এই পৃথিবী পুঁতিগন্ধময় হয়ে যাবে। এই সবুজের রঙ তখন লাল দেখাবে, এই সবুজের ঘ্রান তখন কেমন বিষাক্ত মনে হবে। তোমাদের বেঁচে থাকার দরকার আছে।

0 comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...