27 January 2012 - 0 comments

অঞ্জলী দি(অষ্টম পর্ব)

মনি শংকর হিরো না ভিলেইন? খুব ধাঁধায় পড়ে গেল ম্যাগী। তার সাথে কাজ করছে আজ প্রায় দু সপ্তাহ হয়ে গেল। অসম্ভব সুন্দর আচরণ তার। স্টাফদের সাথে, বন্ধুদের সাথে, সামাজিক ক্ষেত্রেও। বিপরীত লিংগের প্রতি তার আকর্ষণ সুতীব্র। কাউকে পছন্দ হলে আর কোন কথা নেই। ছলে বলে তাকে ভোগ করতে হবে। মদের নেশায় আকন্ঠ ডুবে থাকে। আর তখন সে হয়ে যায় অমানুষ। রেসের মাঠে একের পর এক সম্পদ খুইয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে এক আধবার জিতে যায়। আর এ নেশাটাই তাকে বার বার টেনে নেয় মাঠে। ব্যবসায় কোন মন নেই। দু’হাতে টাকা উড়ায়। সত্যিকারের জমিদারী চালচলন। শুধু জমিদারীটা নেই।

রোহিতের সাথে মনি শংকরের ভিতরে ভিতরে তীব্র দ্বন্ধ। বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই। এ সংঘাত স্বার্থের সংঘাত। তবে অমিতের সাথে সম্পর্কটা বুঝা সত্যি দুষ্কর । সে চাইছে অমিতের মিলটা যেন রোহিত একা ভোগ না করে। আবার সেটা করতে গিয়ে যা করছে তাতে অমিতের ক্ষতি হচ্ছে। সে যে অমিতের শুভাকাংখী নয় সেটাও পরিষ্কার।

প্রশ্ন হলো অমিতকে মেরে ফেললে কার লাভ? তাকে গুলি করার উদ্দেশ্য কি ভয় দেখানো না হত্যা করা? অমিত যদি মারা যায় সকল ভাইবোন সম্পত্তিটা সমান হারে পাবে। বেশী লস হলো রোহিতের। আবার বেঁচে থাকলে লাভও বেশী হলো রোহিতের যতদিন মিল তার দায়িত্বে আছে। সে ক্ষেত্রে মনি শংকর ধীরে ধীরে মিলটাকে ধ্বংস করে দেবে। রোহিতের পক্ষে সেটা সামাল দেয়া সম্ভন না। যদি অমিত নিজে দায়িত্ব বুঝে নেয় তবে সকলেরই লোকসান। তার মানে অমিতের উপস্থিতি সকলের জন্যই অস্বস্তিকর।
সবচে ভাল হয় এখানকার সহায়-সম্পদ যদি সে বিক্রি করে দিয়ে আমেরিকা ফিরে যায়। কিন্তু অমিত তা করবে না। পৈত্রিক সম্পদ সে বিক্রি করবে না। এতে বাপ-ঠাকুর্দা আর বিশেষ করে ঠাকুরমার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়। আবার নিজে সে ব্যবসায়ী নয়, শিল্পপতি নয়। সে একজন বিজ্ঞানী। তার কাজ পড়াশুনা আর গবেষণা। কাজেই মিল ফ্যাক্টরী সে সামলাতেও পারবে না।
এসব বিবেচনা করে ম্যাগী তাকে একবার বলেছিল, “এসব মাথা থেকে মুছে ফেলে চলো আমেরিকা ফিরে যাই।” অমিত রাজী হয় নি।

“আমি কাপুরুষ না। কেউ আমার জানালা দিয়ে দুটো গুলি করলো আর আমি ইদুরের মত লেজ গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাবো, তা হয় না? আমাকে এর শেষ দেখতে হবে।”
সবচে বড় কথা আজও অঞ্জলী মনের কোন হদীস করতে পারেনি অমিত! তার সাথে একটা শেষ বুঝপড়া তো তাকে করতেই হবে।

যখন বিপদ এল তখন ম্যাগীর কোন বিচার বিশ্লেষণই কাজে এল না। অমিতের প্রাক্তন কলেজে বিজ্ঞান ভবনের উদ্বোধন হবে। দেশের নামকরা সব মানুষদের দাওয়াত করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রী নিজে ভবন উদ্বোধন করবেন। সে উপলক্ষ্যে প্রাক্তন কৃতি ছাত্রদের একটা সংবর্ধনাও দেয়া হবে। অমিত এ কলেজের সেরা ছাত্রদের একজন। শুধু তাই নয় কিছু দিন আগেই বিকল্প জ্বালানী উদ্ভাবন বিষয়ক তার ও তার সহযোগী ডেনিস বিজ্ঞানীর যৌথ লেখাটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। পত্রিকা টিভিতে একাধিক সাক্ষাতকার দিয়েছে অমিত। বলতে গেলে এখন সে রীতিমতো বিখ্যাত মানুষ।

ম্যাগী বার বার বারণ করেছিল। “দেখ এটা এমন একটা অনুষ্ঠান যেখানে আমি তোমার সাথে যেতে পারবো না। একা একা বিপদ হতে পারে।” কথাটা অমিতের অহমে লাগলো। একটা জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ নিজের দেশে একটা বিদেশী মেয়ের সাহায্য ছাড়া ঘর থেকে বেরুতে পারবে না এটা কেমন কথা?
“বিপদের ভয়ে আমি মূখে আংগুল দিয়ে চুপ করে ঘরে বসে থাকবো, এটা হয়? আর তুমি তো সারা জীবন আমার সাথে থাকবে না? তখন কি আমাকে চলতে হবে না? বাধা দিও না, আমাকে এখানে এটেন্ড করতেই হবে।”
অমিতের যুক্তি অকাট্য। অগত্যা কাঁধ ঝাকিয়ে চুপ করে গিয়েছিল ম্যাগী।

অমিতের শিক্ষকদের মাঝে মাত্র দুজন এখনও কলেজে আছেন। একজন বর্তমানে প্রিন্সিপাল। তিনি অমিতকে খুব সাদরে বরন করলেন। তার সাথে আরও দুজন প্রাক্তন ছাত্র অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় এলেন, ফিতা কাটলেন । তার পর স্বভাব সুলভ রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে বিদায় হলেন। অমিতও রওয়ানা হলো বড়দার শেভ্রোলে নিয়ে। সে নিজেই ড্রাইভ করছিলো। কলেজটা শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে। মাঝ খানে কয়েক কিলোমিটার একদম ফাঁকা। দু পাশে গজারী বন। তার মাঝখান দিয়ে রাস্তা। কালো পীচ ঢালা আঁকাবাঁকা পথ। উপর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা অলস অজগর শুয়ে আছে।

অমিত খুব সতর্ক হয়ে ড্রাইভ করছে। ম্যাগীর কথা মনে আছে তার। কিছুদূর আসতেই বুঝতে পারলো কেউ তাকে ফলো করছে। একটা ডার্ক-ব্লু গাড়ি। সে স্পীড বাড়ালো। পিছনের গাড়িও স্পীড বাড়ালো। সে আবার কমিয়ে দিল। পিছনের গাড়ি সাথে সাথে স্পীড কমিয়ে দিল। একটা ভদ্র দূরত্ব বজায় রাখছে সব সময়। এমন দূরত্ব যেখান থেকে অমিত গাড়ির ড্রাইভার বা প্যাসেন্জার কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। একটু একটু নার্ভাস লাগছে তার। একবার ভাবলো ম্যাগীকে ফোন দেবে। কিন্তু অহমিকাবোধ তাকে থামিয়ে দিল। দেখতে দেখতে বন পথ পার হয়ে এল অমিত। একটু যেন হাপ ছাড়লো।

বন যেখানে শেষ হয়ে ঘন লোকালয় শুরু হয়েছে সেখানে রাস্তার উপর একটা জটলা দেখতে পেল অমিত। গাড়ির স্পীড কমাতে বাধ্য হলো। দূর থেকে হর্ন বাজাচ্ছে। কিন্তু লোক গুলির মাঝে সরে যাবার কোন লক্ষণ দেখলো না। তাদের পাশ কাটানোর জন্য গাড়িটাকে একদম রাস্তার কিনারায় নিয়ে এল সে। তাও বের হতে পারলো না। এক সময় বাধ্য হয়ে ব্রেক কষে থেমে গেল। মিররে তাকিয়ে দেখল পিছনের গাড়িটা উধাও। সামনের লোকগুলিকে স্থানীয় শ্রমিক মজুর টাইপের মনে হচ্ছে। কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া করছে তারা। অমিতের দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। তার পরও কোটের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিল অমিত। শোল্ডার হোলস্টারে চাপ দিয়ে ল্যুগারটা স্পর্শ করলো। একটু যেন স্বস্তি পেল মনে।

লোকগুলি কিছুতেই রাস্তার উপর থেকে সরছে না। আবার তার দিকে কর্ণপাতও করছে না। ফলে বাধ্য হয়ে গাড়ির কাঁচ নামালো অমিত। কয়েকজন মূর্খ শ্রমিক এমন রাস্তা বন্ধ করে জটলা করছে এটা তার একটুও ভাল লাগলো না। বুঝতে পারলো নেমে ধমক দিতে হবে। হুইল লক করে বাম দিকের দরজা খুলে এক পা বাইরে দিয়েই বুঝলো চরম ভুল করেছে অমিত।

পা আর মাথা একই সাথে বের করেছিল সে। কেউ একজন ধাই করে একটা মুগুর চালালো মাথা লক্ষ্য করে। দূর্দান্ত রিফ্লেক্স এর কারণে মাথাটা সরিয়ে নিতে পারলেও কাধঁটা বাঁচাতে পারলো না। মনে হলো সব হাড় গুড়ো হয়ে গেছে। বাম হাতটা ঝুলছে কাধ থেকে যেন এখুনি খসে পড়বে। চোখে সরষে ফুল দেখল অমিত। ব্যাথায় নাক চোখ মূখ কুচকে গেল তার। পিস্তলের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে বুঝলো সময় নেই। মুগুরটা আবার নেমে আসছে। ততক্ষণে শরীরটা গাড়ি থেকে বের করে ফেলেছে সে। সাই করে সেধিয়ে গেল মুগুরধারীর বুকের সাথে। শূণ্যে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল মুগুর। ফলে ভারসাম্য হারালো মুগুরধারী। কাত হয়ে যাওয়া শরীরটাকে ডান হাত দিয়ে ধরলো। তারপর ছুড়ে মারলো গাড়ির উপর দিয়ে বনের ভিতর। একদম আক্ষরিক অর্থেই পাখির মত উড়ে গেল লোকটা। ততক্ষণে তাকে ঘিরে ফেলেছে জটলার লোকজন।

সবচে কাছের লোকটার চুল খামচি দিয়ে ধরলো অমিত। তার মাথাটাকে বেইস করে লাফ দিল ডান দিকে। যেন পোল ভোল্টার বুবকা উড়াল দিল আকাশে। পড়লো গিয়ে সবচে দূরে দাড়ানো লোকটার বুকের উপর পা দিয়ে। শূণ্যে ভাসার আগ মূহুর্তে চুল ধরা লোকটার মাথাটা ঝাকি দিল নীচের দিকে। গাড়ির কিনারায় মূখ থুবড়ে পড়লো সে। যার বুকের উপর পা দিয়ে পড়েছিল অমিত সে আর উঠে দাড়ালো না। অমিত সোজা হতে যাবে এমন সময় একটা পাথরের টুকরা এসে আঘাত করলো সরাসরি বুকের মাঝে। হুস করে সব বাতাস বেরিয়ে গেল। এলোমেলো হয়ে গেল সে। টলতে টলতে এগিয়ে এল গাড়ির দিকে। যেন নতুন হাটতে শিখেছে কোন বাচ্চা শিশু। দুপাশ থেকে চারজন লোক এসে অমিতের দুই হাত মুচড়ে ধরলো। তার পর ঠেসে ধরলো গাড়ির সাখে। সামনে থেকে আর একটা লোক ধারালো চা পাতি নিয়ে তেড়ে এল। থামলো এসে অমিতের পায়ের রেঞ্জের বাইরে। বাম হাতটা মোটেই নাড়াতে পারছে না অমিত। ডান হাত অক্ষত থাকলেও মুচড়ানো হাত দুটিতে ব্যাথা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না অমিত। চা পাতিওয়ালা তার বাম দিকে চা পাতি তুললো। এক কোপে গলা কাটবে। চোখে চোখ রেখে বললো, “গুড বাই অমিত স্যার।”

চোখ বন্ধ করে ফেললো অমিত। মৃত্যু অনিবার্য। কাজেই হাত টানাটানি করে লাভ নেই। পেশীতে ঢিল দিল। চোখে ভাসলো ঠাকুরমার অনিন্দ সুন্দর মূখ, ম্যাগীর খুনসুটি, অঞ্জলীর অফুরান ভালবাসা আর বন্যার প্রগলভতা। মা-বাবার ঝাপসা স্মৃতিও খানিক উকি দিয়ে গেল মনে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য আর যৌবনের সকল সুখ স্মৃতিগুলিই তার মনে এল। কারো জন্য কিছু ফেলে রেখে গেল কি? না। কারো উপর কোন অভিমান অভিযোগ নেই। স্বর্গ অথবা নরক দেখা হলে বিধাতা পুরুষকে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবে অমিত “সব কিছুই যদি দিলে তবে এমন অসহায় করে পৃথিবীতে পাঠালে কেন?” অমিত ভাবছে আর অপেক্ষা করছে কখন ঝপাত করে গলা কেটে মাথাটা লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু ব্যাটা চাপাতি নিযে দাড়িয়ে আছে কেন? নাকি অমিত মরে গেছে আর মৃত্যুর পর এসব স্বপ্ন দেখছে!! হঠাrকরেই সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। বিশ্ব চরাচরে কিছুই নড়ছে না সব স্থির। অমিতের মনে হলো সে যেন অনন্তকাল ধরে মৃত্যুর অপেক্ষা করে আছে।

তার পর এক সময় অনেক দূর থেকে একটা চীrকার ভেসে এলো। প্রথমে একজনের কন্ঠে তার পর অনেকের কন্ঠে। অমিত ভাবলো মৃত্যুর পর নিশ্চই আত্মীয়স্বজন কান্না কাটি করছে। সে চোখ মেললো্ । বাহ! পরজগত তো দেখি ইহ জগতের মতই। একই রকম গাছ পালা, মানুষজন, শব্দ আর কোলাহল। চাপাতিওয়ালার হাতে একটা ছিদ্র দেখা গেল। সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। চাপাতি ছিটকে পড়েছে দূরে। দুই পাশের লোক গুলিকেও দেখা গেল অমিতের হাত ছেড়ে সবাই নিজ নিজ হাটুর নীচে হাত দিয়ে চীrকার করছে। ঘটনা কি ? যারা ওকে মেরেছে তারাই ওর জন্য কান্নাকাটি করছে? জগতের সব নিয়ম কানুন বদলে গেল নাকি? তারপর অনেক দূর থেকে ভেসে এল পুলিশের সাইরেনের শব্দ। সাথে সাথে লোকগুলি পড়িমড়ি করে ছুটে পালালো। আর তখনই তীব্র ব্যথায় ঝাকুনী খেল অমিতের শরীর। সম্বিত ফিরে এল তার।

নিশ্চই পিছন থেকে পুলিশ ওকে ফলো করছিল। দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণ করতে দেখে তাকে উদ্ধার করার জন্য গুলি করেছে। কিন্তু আশে পাশে তাকিয়ে কোন গাড়ি দেখতে পেল না অমিত। সাইরেনের শব্দটাও নেই। কাধ আর বুকে আগুন জ্বলছে। জ্ঞান হারাবার আগেই ওকে লোকালয়ে পৌছাতে হবে। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়নি। কোন রকমে শরীরটাকে দরজা দিয়ে গলিয়ে স্টিয়ারিঙ হুইলে বসলো। লেফটহ্যান্ড ড্রাইভ। ডান হাত ভাল থাকায় কোন সমস্যা হলো না। কয়েক কিলো মিটার যেতেই প্রথম যে হাসপাতালটা পড়লো সেটার সামনে গাড়ি থামালো সে। গাড়ি থেকে নামতে নামতে বন্যাকে ফোন দিল। কেন দিল সে জানে না। হয়তো নাম্বারটা সামনে ছিল তাই। জ্ঞান হারাবার আগে মোবাইল মূখের সামনে নিয়ে শুধু হাসপাতালের নামটা উচ্চারণ করতে পারলো।

বন্যা কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিলো । ছোট কাকুর একটা অসম্পূর্ণ কল পেয়ে যারপর নাই বিস্মিত হলো সে। তবে বুদ্ধি হারালো না। নিশ্চই ছোট কাকু বা অন্য কারো কোন বিপদ হয়েছে। সে তrক্ষণাত গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো। বাবা দেশে নেই। যেতে যেতে সে তার মা আর ছোট মা অর্থাr বিন্দু কে ফোন দিল। তবে কাউকেই সে ক্লিয়ার করে কিছু বলতে পারলো না। শুধু তার অনুমানের কথা জানালো। প্রত্যেকেই তাকে হাজারটা প্রশ্ন করলো। সে কারো প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না।

স্টিয়ারিঙএর উপর মাথা রেখেই জ্ঞান হারালো অমিত। তার পিছন পিছনেই ব্রেক করলো আর একটা ডার্ক-ব্লু গাড়ি। সেখান থেকে একজন মানুষ নামলো। অমিতকে বের করে নিয়ে গেল হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে। কর্তব্যরত ডাক্তার অমিতকে দেখেই চিনতে পারলো। দ্রুত তাকে ওটিতে নেয়া হলো। পেপারস সাইন করাতে এসে দেখা গেল অমিতকে যারা নিয়ে এসেছিল তারা নেই। তাতে সমস্যা হলো না। কয়েক মিনিটের মাঝেই প্রথমে বন্যা এবং প্রায় একই সাথে বিন্দু আর মঞ্জূ এসে হাজির হলো। অপারেশন চলার মাঝেই এল মনি শংকর । সাথে তার পি এস ম্যাগী। রোহিত খবর পেয়ে সাথে সাথেই দেশের পথে রওয়ানা দিল।

আঘাত বেশ গুরুতর। কাঁধ এবং বুক দুজায়গাতেই কম্পাউন্ড ফ্রাকচার হয়েছে। জীবনের আশংকা নেই। তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে। মনি শংকর ম্যাগীকে মঞ্জূ আর বন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। বিন্দু ওকে আগে থেকেই চেনে। মনি শংকর যখন ম্যাগীর পরিচয় দিল আমার পিএস, বিন্দু তখন মূখ বাঁকা করলো। যার অর্থ পিএস না রক্ষিতা সবই আমি জানি। মনি শংকর সেটা লক্ষ করলেও আর কেউ সেটা বুঝতে পারলো না। রাতে মঞ্জু থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু রোহিত ফিরে আসছে তার পক্ষে থাকা সম্ভব না। বন্যা কিছুতেই ছোট কাকুকে ছেড়ে যাবে না। বিন্দুও না। ঠিক হলো রাতে বন্যা আর বিন্দু অমিতকে এটেন্ড করবে। মঞ্জু, ম্যাগী খোঁজ খবর নেবে। ফিরে আসার আগে মনি শংকর ডাক্তারের সামনে দাড়ালো। “ডক্টর, অমিত আমার ভাই, আগামীকাল সকালে আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।” কি ছিল তার কন্ঠে কে জানে। ডাক্তার কাচুমাচু হয়ে শুধু বললো, “আমি চেষ্টা করবো স্যার।”

সারা রাত দু চোখের পাতা এক করেনি বন্যা। ঠাই জেগে বসে রয়েছে অমিতের মাথার পাশে। বিন্দু বার বার করে বলেছে, “তুই একটু ঘুমিয়ে নে, আমি তো আছি, তোর শরীর খারাপ করবে।” কিন্তু বন্যা শুনেনি। বরং জোর করে বিন্দুকে ঘুমুতে পাঠিয়েছে। “তুমি যাও তো ছোট মা। এ বয়সে রাত জাগলে বরং তোমার ক্ষতি হবে।”

“ওরে আমার বুড়ি, কি এমন বয়স হয়েছে আমার? তোর ছোট কাকুর চেয়েও আমার বয়স কম।”

“ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। তুমি আমার ছোট্ট খুকী। এখন যাওতো! একটু ঘুমাও গে।”

সুইংডোর ঠেলে বিন্দু চলে গেল পাশের রুমে। বন্যা ঘরময় পায়চারী করছে আর খানিক পর পর অচেতন অমিতের যন্ত্রণাকাতর মূখের দিকে তাকাচ্ছে। সদ্য তরুণীর ছোট্ট বুকটাতে কি গভীর মায়া যে খেলা করছে তা বলে বুঝানো যাবে না। অচেতন অবস্থার মাঝেই অমিতের প্রতিটি মৃদু মুভমেনেন্টর সাথে বন্যার মূখের অভিব্যক্তি পাল্টে যাচ্ছে। ব্যাথাটা যেন অমিত নয় বন্যা নিজে অনুভব করছে। হঠাr মনে হলে দূর্ঘটনার খবরটা মাসিমনিকে জানানো হয়নি। রাত প্রায় দুটো বাজতে চলল । কিছু যায় আসে না। তার সুখ-দুঃখের সবচে প্রিয় সাথী হলো মাসিমনি। দুনিয়ার এমন কোন কথা নেই যা সে তার মাসিমনির সাথে শেয়ার করে না। তার সাথে তার সময়ের কোন বালাই নেই। দরজা খুলা রেখেই ক্যাবিনের বারান্দায় চলে এল সে।
ফোন করলো মাসিমনিকে। প্রথমবার রিং হতেই অঞ্জলী রিসিভ করলো। যেন রাত দুটো পর্যন্ত জেগে বসেছিল ফোন ধরার জন্য।

“কি হয়েছে বন্য মা?”

“তুমি জেগে ছিলে?”

অঞ্জলী জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “কেন ফোন দিয়েছ বল?”

“ছোট কাকু গুরুতর আহত হয়েছেন।”

“এখন কেমন আছেন তিনি?”

“জানি না। সেন্ট্রাল হাসপাতালে রয়েছেন। আমি আর ছোট মা তাকে এটেন্ড করছি। ডাক্তার বলেছেন জীবনের আশংকা নেই। তবে সেরে উঠতে সময় লাগবে। কাকুর খুব কষ্ট হচ্ছে মাসিমনি।” ডুকরে কেঁদে উঠলো বন্যা। ক্যাবিনে যাতে শব্দ না যায় সে জন্য নিজেই মূখে হাতচাপা দিল। অঞ্জলীর ওপাশ থেকেও কি ফোপানোর শব্দ পাওয়া গেল একটা? নিজের কান্না চাপতে ব্যস্ত থাকায় বন্যা বিষয়টা বুঝতে পারলো না।

“তুমি সাবধানে থেকো মা। আর কাকুর দিকে খেয়াল রেখো। আমার ফোন খোলা আছে। যখন খুশী আমাকে রিং করে জানিও।”

রোহিত খুব চিন্তিত আর বিমর্ষ। ট্যুর অসমাপ্ত রেখে ব্যাংকক থেকে ফিরে এসেছে। বাসায় না গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি হাসপাতালে এল সে। এক মাত্র কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে রোহিত ভালই ছিল। নিজের অংশ থেকে আয় রোজগার মন্দ হচিছল না। আবার অমিতের মিল থেকে মূনাফা না হলেও এর একটা ফিনান্সিয়াল এক্সপোজার ছিল। কিছু অসr কর্মচারীর লোভের কারণে মিলটা মূনাফার মূখ দেখছে না। ওদের নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়। এক দিকে ইউনিয়ন আর এক দিকে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ মিলটাতে আস্তানা গেড়েছে। ওদের ম্যানেজ করেই চলে যাচ্ছিল কোন রকমে। কিন্তু অমিত আসার পর সব কেমন জানি গোলমাল হয়ে গেল।

রোহিত যখন হাসপাতালে এল তখনও ভোরের কুয়াশা কাটেনি। তার গাড়িটা মেইন গেইটে আসার আগে আগে সাঁ করে একটা ডার্ক-ব্লু বেরিয়ে গেল। সে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছে। এখন তাকে ভিতরে যেতে দেবে না। বন্যাকে খবর দেয়া হয়েছে। বিন্দুকে অমিতের কাছে রেখে বন্যা এসেছে বাবার কাছে। রোহিতকে দেখতে পেয়েই কান্নায় ভেংগে পড়লো সে। “বাবা, ছোট কাকু….”কথা শেষ করতে পারল না। কান্নার দমকে গলার স্বর বুজে এল। রোহিত হাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিল।
“ডোন্ট ওয়ারী ব্যাটা, এভরিথিং উইলবি রাইট।” মেয়ের পিঠে সান্ত্বনার চাপড় দিল রোহিত।

সাতটা নাগাদ জ্ঞান ফিরলো অমিতের । চোখ মেলে দেখল বিন্দু বসে আছে তার মাথার পাশে। শরীরটা ভীষণ ভারী। কাধঁ আর বুকে প্লাস্টার। প্রথমে বুঝতে পারলো না সে কোথায় আছে, কি করছে। সামান্য নড়াচড়ায় তীব্র ব্যাথা লাগলো তার। ব্যাথার চোটে চোখ দিয়ে পানি এসে গেল। সেই সাথে মনে পড়লো সব কিছু। বিন্দু সরাসরি তাকিয়েছিল তার দিকে। ব্যাথার ধরণটা দেখে কেঁপে উঠলো বুকের ভিতর। আঁচল দিয়ে অমিতের চোখের কোণ মুছে দিল।
“নড়াচড়া করো না ঠাকুর পো।”

“আমি এখন কোথায় মেজবৌদি?”

“এটা হাসপাতাল। তুমি আঘাত পেয়েছ। তোমার চিকিrসা চলছে। কোন কথা বলো না। আমি ডাক্তারকে খবর দিচিছ।” বেল টিপে সিস্টারকে ডাকলো বিন্দু। সিস্টার ডাক্তারকে খবর দিল।

বিন্দু অমিতের জ্ঞান ফেরার খবর মনি শংকরকে জানাল, বন্যাকেও মোবাইলে ইনফরম করলো। মনি শংকরকেও জানালো। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার এল ক্যাবিনে। তার পেছন পেছন এল রোহিত, বন্যা এবং মনি শংকর। অমিতকে কথা বলতে দেখে ডাক্তারের মূখে হাসি ফুটলো। রসিকতা করতেও ছাড়লো না। “এটা নিশ্চই সিআইএ ‘র কাজ। তারা চায় না বিকল্প জ্বালানী উদ্ভাবনের ফর্মূলা ওরা ছাড়া আর কারো হাতে থাকুক। ঘাবড়াবেন না স্যার, কোটি কোটি মানুষের সুখের ভার যে কাধেঁ সে কাঁধ এত সহজে ভাংবে না।” কথা শেষ করে ঘুরতেই ডাক্তার মুখোমূখি হলো মনি শংকরের। “ওয়েলডান ডক্টর, থ্যাংকিউ।

মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে ম্যাগীর। এত করে বারণ করা স্বত্বেও অমিতকে সে থামাতে পারেনি। এখন বিষয়টা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে সে কিছুতেই আর অমিতের সাথে খোলাখুলি দেখা করতে পারছে না। বাইরে সে একজন সাংবাদিক আর মনি শংকরের টেম্পোরারী পিএস। একমাত্র অঞ্জলী জানে অমিতের সাথে তার যোগাযোগ আছে। সেটাও জানে ভুল। অঞ্জলীর ধারণা সে অমিতের স্ত্রী। যে করেই হোক এ ভুল ভাংগাতে হবে। অমিতের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

সে ফোন তুললো, “অঞ্জলী আমি তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাই।”
“আমার মনটা ভাল নেই ম্যাগী। আমরা পরে সাক্ষাত করি?”
“না, আজ এখুনি, কোথায় আসব বল?”
“তোমার সাথে আমার দেখা করতে ইচ্ছে করছে না ম্যাগী, তুমি কিছু মনে করো না।”
“অবশ্যই করবো, তোমার মন আছে আমার মন নেই?”
“তা থাকবে না কেন? স্বামীর এমন অবস্থায় স্ত্রীর মনইতো সবচে বেশী খারাপ হয়।”
“জাস্ট শাট আপ। আমি ওর স্ত্রী নই। ফোনে সব বলতে চাইনা। আমি আসছি।”

ম্যাগী যখন আশ্রমে এল অঞ্জলীর সাথে দেখা করতে তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। দীঘির পাড়ে মন খারাপ করে বসেছিল অঞ্জলী। এসময়ে কেউ তাকে বিরক্ত করে না। ম্যাগী নাছোড়বান্দা। তাই বাধ্য হয়ে সুদীপা মোবাইলে অঞ্জলীকে রিং দিল।
“সরি ম্যাডাম, সাংবাদিক মহিলা এমন করে বলছেন যে আপনাকে বিরক্ত করতে হলো।”
“ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।”

অঞ্জলীর চোখের নীচে কালির ছাপ। চোখে মূখে রাজ্যের ক্লান্তি। বিষন্ন, মলিন। ম্যাগীর খুব মায়া হলো ওকে দেখে।
“একি হাল হয়েছে তোমার” খুব আন্তরিক ভাবেই বললো ম্যাগী।

“আমার কথা বাদ দাও, তুমি কেন এসেছ বল?”

“অমিত খুব বিপদের মধ্যে আছে, ওকে বাঁচাতে হবে।”

“কেউ তো মানা করছে না, এ ক্ষেত্রে আমার কি করার আছে?”

“তোমার করার আছে, কারণ তোমার জন্যই আজ তার এ বিপদ।”

“হোয়াট ননসেন্স?”

“যতই গালি দাও এটাই সত্য। আমি চেষ্টা করেছিলাম ওকে আমেরিকা ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু সে যাবে না। তোমাকে ছেড়ে সে কিছুতেই যাবে না?”

“আমার সাথে তার কিসের সম্পর্ক?” অঞ্জলী রেগে গেল।
“সেটা তুমি জান আর অমিত জানে, আমাকে চোখ রাঙিয়ে কোন লাভ নেই।” ম্যাগীও কড়া গলায় জবাব দেয়।

“স্ত্রী হও আর গার্লফ্রেন্ড হও, সম্পর্ক যা কিছু সবই তোমার সাথে। আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।”

“তুমি আউট অব জেলাসী এসব বলছ। অমিত আর তুমি পরস্পরকে ভালবাস। আমি জানি।”

“জাস্ট শাট আপ। আমি তোমার প্রতি জেলাস হবো কেন? মন খারাপ করেছি আমার কাছে সম্পর্কটা লুকিয়েছ বলে।”
“তোমার কাছে কিছুই লুকানো হয়নি। আমরা দিনের পর দিন একই ছাদের তলায়, একই ঘরে, একই বিছানায় রাত কাটিয়েছি। কিন্তু আমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই। কোন দিন সে সচেতনভাবে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। ম্যাক্সিমাম আমাকে তার প্রাইভেট সেক্রেটারী বলতে পার।”

“বিশ্বাস করতে বলছ?”

“বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার।”

সে ম্যাগীর হাত চেপে ধরলো, “তুমি সত্যি জান সে আমাকে ভালবাসে?”

“জানি, আর তুমিও যে তাকে ভালবাস এটা নিশ্চিত হবার জন্যই এত নাটক। তবে তুমি এয়ার পোর্টে না যাওয়াতে অমিত খুব হতাশ হয়েছিল।”

“মনি শংকরকে এড়ানোর জন্যই আমি এয়ারপোর্টে যাইনি”

“তুমি কি জান, প্রথম দিন রাতেই তার উপর আততায়ী হামলা করেছিল? তোমার কাছে সেটাই বলতে এসেছিল সে। আর তুমি তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। তোমার কাছে ছুটে এসেছিল আশ্রয়ের আশায়। আর অভুক্ত অসহায় মানুষটাকে তুমি আঘাত করেছিলে নিষ্ঠুরভাবে।”
“আসলে আমি চাইনি আমার জন্য পিছুটান থেকে তার দাম্পত্য জীবনে কোন ছন্দ পতন ঘটুক।”

“ভুল করেছিলে তুমি”

অঞ্জলী চুপ মেরে গেল। তাই যদি হয় তাহলে অমিতের উপর খুব অন্যায় করা হয়েছে। সে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।

“আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলো ম্যাগী।”

“আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। এখানে আমি অমিতের কেউ না। আচ্ছা তুমি কি ধারণা করতে পার কারা অমিতের উপর হামলা করতে পারে?”

“না আমার কোন ধারনা নেই।”

কিছু বিষয় আছে যা কখনও শেয়ার করতে হয় না। কারও সাথেই না। ঠাকুরমা-অঞ্জলী-মঞ্জুর সম্পর্ক, অমিত-ঠাকুরমার সম্পর্ক, অমিত-সরলার সম্পর্ক, অঞ্জলী-ম্যাগীর সম্পর্ক বা অমিত-ম্যাগীর সম্পর্কগুলি শেয়ার করার মত নয়। এগুলি তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এধরণের সম্পর্কগুলি যদি গোপন না থাকে তবে জগত সংসারে বিশৃংখলা দেখা দেবে। তেমনি কিছু কাজও গোপন রাখতে হয়। যেমন অঞ্জলী কাউকে বলেনি কিছু লোককে গাড়ি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার কথা। এমনকি ম্যাগী, অমিত বা সুব্রতকেও না। আবার ওরা যে অমিতের আততায়ী তাও জানে না। তেমনি অঞ্জলী কখনও কাউকে বলবে না সেদিন অমিতকে সেইভ করার কথা।

অমিত যেদিন প্রথম আক্রান্ত হলো সেই রাত থেকেই ডার্ক-ব্লু গাড়িতে করে তাকে ফলো করে আসছে অঞ্জলী। গাড়িটা ভাড়া করা এবং দূরের একটা গ্যারেজে রাখা হয়। সে নিজে ড্রাইভ করে। গোপনীয়তার জন্যই সে একা কাজ করে। মাঝে মাঝে সে অমিতকে হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে ম্যাগী যখন তাকে শেখের ছদ্মবেশে হোটেলে নিয়ে রাখতো তখন। বাকী সময়টা অনেক দূর থেকে অমিতকে ফলো করে অঞ্জলী।

কলেজে বিজ্ঞান ভবন উদ্বোধনের দিনও তাকে অনুসরণ করছিল। বন পথে অমিত আক্রান্ত হবার আগ মূহুর্তে অঞ্জলী তার পিছনেই ছিল। যখন অমিত গাড়ি ব্রেক করলো তখন অঞ্জলী তার গাড়ি বনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সে যখন পার্ক করায় ব্যস্ত তখনই অমিত আক্রান্ত হয়। চীrকার করে সাবধান করার সময় ছিল না। তাই সরাসরি গুলি করে অঞ্জলী। তবে সতর্ক ছিল যাতে কেউ মারা না যায়। আর পুলিশের সাইরেনের শব্দওয়ালা খেলনাগাড়ি এখন ফুটপাতেই পাওয়া যায়। ভয় দেখানো আর ডাইভারশন তৈরী করার জন্য খেলনা গাড়ি দিয়ে আওয়াজ করেছিল অঞ্জলী। তার পর গাড়ি নিয়ে অমিতকে ফলো করেছে হাসপাতাল পর্যন্ত। হাসপাতালের কাছে গিয়ে অমিত জ্ঞান হারিয়েছিল। তখন অঞ্জলীই তাকে ইমারজেন্সীতে নিয়ে যায়। সে পুরুষের ছদ্মবেশে ছিল। তাই বন্যা ঢুকে তাকে দেখেও চিনতে পারেনি। বন্যা ঢুকার পর সে সেখান থেকে সরে পড়ে। তার পর আবার রাত দশটা থেকে হাসপাতালের গেটে বসে থাকে ভোরে রোহিত ঢুকার আগ পর্যন্ত। এসব তথ্য সে কাউকেই শেয়ার করবেনা। যেমন পুলিশের ভয় আছে, তেমনি শত্রুরাও সতর্ক হয়ে যাবে। তবে সে সত্যি জানে না কারা অমিতকে হামলা করতে পারে।

অমিতকে যারাই আক্রমণ করুক, অঞ্জলী তাদের খুজেঁ বের করে শাস্তি দেবে। চরম শাস্তি। এ্টা তার একার যুদ্ধ। এখানে সে কাউকে সাথে নেবে না। ম্যাগী বা সুব্রতকেও না। যদি রায় পরিবারের ভিতরেই থাকে ভিলেইন তবে পুলিশ বা ম্যাগী দূর্বল সহযোগী।

একটা বিরাট হলঘরের মাঝখানে একটা টেবিলের একপাশে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে সাতজন লোক। টেবিলের অপর পাশে একজন লোক চুপ করে বসে আছে। একটা উজ্জ্বল আলো টেবিলটাকে দুইভাগে ভাগ করেছে। একভাগে টেবিলসহ সিংগেল লোকটা অন্ধকারে। তাকে দেখাচ্ছে একটা ছায়ার মত। অন্যভাগে দাঁড়ানো সাতজন আলোর ভিতর। বসা লোকটা এক এক করে সাতজনকে একটা লাঠি দিয়ে গুতো দিয়ে পরীক্ষা করছে। নাক-মূখ থেতলা, পাজর ভাংগা, হাত ছিদ্র, হাটু ভাংগা, উরু ছিদ্র, পায়ের পাতা অর্ধেক প্রায় নেই। “বাহ তোদেরকে এমন আদর করে মারলো কে রে” ছায়ার খ্যান খ্যানে কন্ঠ। “বুঝাই যাচ্ছে তোদের জানে মারতে চায়নি। তোদের মত অপদার্থ পুষে আমার কি লাভ শুনি? সাতজন মানুষ একটা অপ্রস্তুত লোককে ঘায়েল করতে পারলি না, শীট!!!
“বস্* লোকটার গায়ে অসুরের শক্তি। আর অসম্ভব ক্ষিপ্র। তাও আমরা শেষ করতে পারতাম। কিন্তু কোথা দিয়ে যে পুলিশ চলে এল বুঝতেই পারলাম না।”

“প্রশ্নটা আমারও” ছায়া বললো, “পুলিশ আসার কথা না। হুম, আমি দেখছি। এবারের মত বেঁচে গেলি। আগামী একমাস গর্তে লুকিয়ে থাকবি। তোমাদের চাঁদ বদন যেন বিশ্ব চরাচরে কেউ দেখতে না পায়। আর একটা কথা সাতজন সাত দিকে থাকবি। নাউ গেট লস্ট।”

নিজের ঘরে বসে অমিতের সাথে তোলা তার ছবি গুলি দেখছিল অঞ্জলী। অনেক অনেক ছবি। বড় বড় পাঁচটা এলবাম। নানান ঘটনার, নানান ধরণের স্মৃতি। কিছু কিছু ছবি আছে খুবই অন্তরংগ। দেশ ছাড়ার আগে তাদের মাঝে সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্টতায় রূপ নিয়েছিল। যেদিন অমিতের রেজাল্ট হলো সেদিনই প্রথম অমিতকে চুমু খেয়েছিল অঞ্জলী। গাঢ়, কঠিন চুমু। নির্জন পার্কের বেঞ্চিতে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল। তবে অনভ্যস্ত অমিত রিটার্ন করেনি। লজ্জায় লাল হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে। উত্তেজিত অঞ্জলী মনেপ্রানে চাইছিল অমিত তাকে ভোগ করুক। তার টুইটুম্বুর যৌবনসুধা চেটেপুটে খাক অমিত। কিন্তু অমিত লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অঞ্জলী অতিষ্ঠ হয়ে মূখ ফুটে বলেছে “আমায় আদর কর রাজ কুমার, তোমার অঞ্জলীকে তুমি গ্রহণ কর।” তার গলা ফ্যাসফেসে, প্যান্টি ভিজে উরু বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ছে। অমিত শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে দুই স্তনের মাঝখানে মূখ লুকিয়ে চুপ করে থেকেছে। ছোট্ট শিশু যেমন করে মায়ের বুকে মূখ লুকায়। অঞ্জলী বুঝেছে অমিতের আরও সময় লাগবে। সে আর বাড়াবাড়ি করেনি। এসব ঘটনার এর ছবি সে মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রেখেছে। আজ এত দিন পর এসব ছবি দেখতে দেখতে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে তার।

হঠাr মোবাইলের শব্দে সম্বিত ফিরে তার। রাম লালের ফোন।
“বলো রামু কাকা”
“মা জননী, আমি একবার তোমার ঘরে আসবো?”
“ওমা এস, এত ফরমালিটির কি আছে?”
“ঠিক আছে মা জননী, আমি আসছি”

রামলাল দারোয়ান। আসলে দারোয়ান না বলে তাকে সিকিউরিটি ইনচার্জ বলা ভাল। লেখা পড়া জানে। আর্মিতে ছিল। সুবেদার বা হাবিলদার এধরণের কিছু। চির কুমার। জগত সংসারে আপনার বলতে কেউ নেই। অসম্ভব সাহসী আর বিশ্বাসী। এ বিশাল বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় তার নজর আছে। তার নজর এড়িয়ে একটা পাখীও গলাতে পারে না। তবে যাদের অনুমতি আছে তাদের ব্যাপারে কখনও নাক গলায় না। ঠাকুরমা তাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। প্রতিমা, অমিত কিংবা তাদের বয়সী রায় বাড়ির প্রায় সকল ছেলে মেয়ে তার কোলে পিঠে মানুষ হয়েছে। বিশেষ করে অমিত ছিল তার চোখের মনি। ছোট বেলা মা-বাবা হারানোর কারণে ঠাকুরমার মত রামলালও ছিল অমিতের প্রতি এক্সট্রা কেয়ারিং। রাজ শেখর রায় চৌধুরীও আর্মিতে ছিলেন। তিনি ছিলেন ইঞ্জিয়ারীং কোরের লোক। রামলাল একসময় তার অধীনে ছিল। সে সময় এক অপারেশনে রাজশেখর তার জীবন বাচিয়েঁ ছিলেন। ব্যাস, তখন থেকেই রামলাল মুফতে পাওয়া জীবনটাকে রায় বাড়ির জন্য উrসর্গ করতে এক পায়ে খাড়া। এ বাড়ির লোকজনও তাকে সম্মানের চোখে দেখে।

দরজায় নক হতেই ভেতর থেকে অঞ্জলী ডাকলো, “এস রামু কাকা।” রামলাল ঘরে ঢুকে নমস্কার করে এক কোণায় কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে রইল। অঞ্জলী বিছানায় আধশোয়া ছিল। তাকে দেখে উঠে বসলো। পাশের একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললো। রামলাল কিছুতেই বসবে না। অঞ্জলীকে সে ঠাকুরমারচেও বেশী সমীহ করে। অঞ্জলী উঠে গিয়ে হাত ধরে টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
“শুন রামু কাকা, এখন তো অফিস আওয়ার নয়, তুমি আমার ঘরে আমার অতিথি। চুপটি করে বসো, চা খাও।”

অঞ্জলী তাকে চা-জল খাবার দেয়। নিজেও এক কাপ চা নিয়ে তার সামনে বসে। “এবার বল কি জন্য এসেছ?”
অঞ্জলীর আন্তরিকতা সবসময়ই ভাললাগে তার। আজ যেন সেটা বেশী করে চোখে পড়লো। বড় মা জননী ছাড়া এত সম্মান আর কেউ করে না। তার চোখের কোন চিক চিক করে উঠলো। তবে প্রফেশনাল বলে বুঝতে দিল না।
“আমার একবেলা ছুটি দরকার মা জননী।”
“কোথাও বেড়াতে যাবে?”
“না গো মা জননী, রাজা বাবুকে দেখতে যাব। সেদিন তিনি এসেছিলেন। আমি চিনতে পারিনি। যখন পারলুম তখন তিনি আহত। আমার বড় মায়া লাগছে মা জননী।”

“বেশ তো যাও। আর শুন, তুমি কিন্তু গাড়ি নিয়ে যাবে। রাজা বাবুর ভিজিটর বলে কথা। কোন অজুহাত করবে না । এটা আমার হুকুম। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।”

“আজ্ঞে মা জননী।”
ঘরে ফিরে নিজের সবচে সুন্দর জামাটা বের করলো রামলাল। তার পর লোহার বড় সেফটা খুললো। সেফটা এত বড় যে এর মাঝে অনায়াসে দুতিনজন মানুষ দাড়িয়ে থাকতে পারবে। এটা দেয়ালের সাথে লাগানো একটা বিল্ট ইন সেফ। শুধু সামনের দরজাটা লোহার তৈরী। এটার মধ্যে কি আছে সে ছাড়া কেউ জানে না। তার ঘরে কেউ কখনও ঢুকেও না। সেফের ভিতর থেকে পলিথিনে মোড়ানো দুটি ফোল্ডার বের করলো সে। একটাতে একটা ব্লু প্রিন্ট। আর একটায় একপাতার একটা হাতে লেখা দুই শীট কাগজ। অনেকটা চিঠির মত। একটা শীট খুব পুরনো। আর একটা শীট এর ফটোকপি। ব্লু প্রিন্টায় একবার চোখ বুলিয়ে রেখে দিল সেফে। হাতে লেখা কাগজের ফটোকপিটা খুব সাবধানে পাঞ্জাবীর বুক পকেটে নিল। তারপর ঘরের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলো।

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো “কোথায় যাবো?”
“সেন্ট্রাল হাসপাতাল”

রামলাল যখন হাসপাতালে পৌছাল তখন সন্ধ্যে উতরে গেছে। ডাক্তার রাউন্ড শেষ করে গেছেন। অমিতের আঘাতটা বাইরে থেকে বুঝা যায় না। ভিতরে খুবই ক্ষতি করেছে। কাধেঁর আঘাতটা তেমন গুরুতর নয়। তবে বুকের আঘাতটা খুবই মারাত্মক। বুকের খাঁচার হাড় ভেংগে ছোট টুকরা মাংসের সাথে গেথে গেছে। ভাংগা হাড় জোড়া লাগার চেয়েও মাংসের ভিতর সেধিয়ে থাকা হাড়ের টুকরা অপসারণ করা জরুরী। ডাক্তার সন্দেহ করছেন অপারেশন ছাড়া শুধু মেডিসিনে সেটা সম্ভব নয়। ব্যথাটাও সারছে না সেজন্যই। পেইন কিলার তেমন কাজ করছে বলে মনে হয় না।

রামলালের হাতে দুটো প্যাকেট। কিছু ফলমুল এনেছে সে তার রাজা বাবুর জন্য। ঘরে ঢুকে দেখল বন্যা একটা চেয়ারে চুপ করে বসে আছে। অমিত আধা ঘুম আধা জাগরণের মাঝখানে ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে। বন্যাকে দেখে হাত তুলে নমস্কার করলো রামলাল। “দিদি মনি, রাজা বাবু এখন কেমন আছেন?”
“বেশী ভাল না রামু দা, ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন।”
“আমি কি কথা বলতে পারবো?”
“বল তবে খুব সংক্ষেপে।”
“ঠিক আছে দিদি মনি, আমি শুধু কিছু সময় বসে থাকবো। ততক্ষণ আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন।”
বন্যা কিছু সময়ের জন্য পাশের রুমে যায়। বিন্দু বিকালে চলে গেছে। রাতে আবার আসবে। রামলাল থাকা অবস্থায় একটু বিশ্রাম নিলে মন্দ হয় না।

রামলাল একটা টুল টেনে অমিতের মাথার কাছে বসলো। কপালে একটা হাত রেখে দেখল তার গায়ে তীব্র জ্বর। কপালে হাতের ছোয়া পেয়ে অমিত চোখ মেলে তাকালো। উঠে বসার চেষ্টা করতেই রামলাল হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল।
“কেমন আছেন রাজা বাবু, আমি সেদিন আপনাকে চিনতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।”
অমিত ভাল হাতটা দিয়ে রামলালের একটা হাত চেপে ধরলো। কোন কথা বললো না। রামলালও চুপ করে বসে রইল অমিতের হাত মুঠিতে নিয়ে। অনেক অনেকক্ষণ পর ফিস ফিস করে বললো, “ভু-ভারতে কার এত বড় বুকের পাটা আমার রাজাবাবুর গায়ে হাত দেয়। একবারটি আমাকে দেখিয়ে দিন। আমি মশা মারার মত করে ওদের পিষে মারবো।”
শ্বাপদের মত জ্বলে রামলালের চোখ। আততায়ীদের পেলে যে মশা মারার মতই মারবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। অমিত কথা বলে না। শুধু হাতের চাপ সামান্য একটু বাড়ে। রামলাল পাশের রুমের দরজার দিকে একবার দেখে। তারপর পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সন্তর্পণে ভাজ করা চিঠিটা অমিতের হাতে দেয়। ফিস ফিস করে বলে, “বড় মা জননী মৃত্যুর আগে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন কাকপক্ষীর অগোচরে এটা যেন আমি আপনাকে দেই। আপনার সাথে দেখা হবার আগে যদি মরে যাই তাহলে যেন ধ্বংস করে ফেলি। লোক জানাজানি হলে নাকি আপনার বিপদ হবে। এখানে কি আছে আমি জানি না। মূল কপি নিরাপদে আছে। এটা ফটোকপি। একবার চোখ বুলিয়ে আমাকে ফেরত দিবেন। সুস্থ্য হলে এটা নিয়ে যা করার করবেন।”

অমিত চোখ বুলাল। বাংলা ইংরেজিী মেশানো একটা মামুলী চিঠি। এটার গোপনীয়তার গুরুত্ব অমিত বুঝতে পারলো না। হয়তো ঠাকুরমার কথাকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই রামলাল এটা বলেছে। তবুও সাবধান হলো অমিত। চিঠিটা পড়লো। তারপর ফিরিয়ে দিলো রামলালকে। তার ফটোগ্রাফিক মেমোরী। একবার পড়েছে। জীবনে আর কোন দিন ভুলবেনা।

Dear বিদ্রোহী রাজকুমার,
আমার চিঠি যখন পাবে আমি তখন পরপারে। যাবার আগে আমি আমার সকল Asseet তোমাদের মাঝে ভাগ করে দিয়েছি। আমার নিজের বলতে গেলে এখন আর কিছুই নেই। আমি জানি তুমি ভালো মানুষ হিসাবেই বড় হয়েছ। ফলে আমার ভাগাভাগি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। তবে জগতে ছোট বড় সবধরণের মানুষ আছে। সবার কাছে সবটা পছন্দ নাও হতে পারে। যাই হোক পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখার চেষ্টা করো। কোম্পানী চালাতে হলে Bank আর Union এই দুটোর উপরই তোমাকে নির্ভর করতে হবে। তবে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে সতর্ক থেকো। তোমার Knowledge-Attitude-Endevour তোমাকে পথ দেখাবে। শুধু A নয় আমি তোমাকে A টু Z ভালবাসি।

ইতি

ঠাকুরমা

চিঠির মাথা মুন্ডু তার মাথায় কিছুই ঢুকল না। তবে প্রতিটা শব্দ মনে গেথে রাখলো। যাবার আগে রামলাল অমিতের কপালে নাক ছোয়াল। সন্তানহীন রামলালের কাছে অমিত সন্তানের মত। চাকর-মনিবের কোন ব্যবধান এখানে একেবারেই নেই।

রামলাল চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই সুব্রত এলো অমিতের কেবিনে। মনি শংকর গত রাতেই একটা ডায়রী করেছিল থানায়। ডায়রীর সূত্রে অমিতের সাথে কথা বলার জন্য সুব্রত এসেছে। তখনও বন্যা একাই অমিতকে এটেন্ড করছিল। বিন্দু এসে পৌছায়নি। সুব্রত এসে ডাক্তারের অনুমতি নেয়। তারপর অমিতেরও সম্মতি নেয়। অমিত যখন জানাল সে কথা বলতে পারবে তখন সুব্রত বন্যার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে। বন্যা বুঝতে পারে সুব্রত একা কথা বলবে।

বন্যা চলে যেতেই সুব্রত বলে, “স্যার আমি দুঃখিত আপনার নিরাপত্তায় আমরা যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারিনি। গত দুই দিন আমি একটা স্মাগলার গ্রুপকে তাড়া করছিলাম সীমান্ত পর্যন্ত। তবে কথা দিচ্ছি হামলাকারীদের আমি আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবো।”

“থ্যাংকিউ অফিসার।”
“স্যার আপনি কি কাউকে চিনতে পেরেছেন?”
“না”
“কাউকে সন্দেহ করেন?”
“না”
“স্যার আমি আপনাদের অনাথ আশ্রমে মানুষ। মিস অঞ্জলীকে আমরা মায়ের মত জানি। এই আশ্রম আমার মত শত শত ছেলে মেয়েকে জীবনের পথ দেখিয়েছে। আপনি আমাকে পুলিশ না ভেবে একজন গুণমুগ্ধ সেবক হিসাবে সব কিছু খুলে বলতে পারেন।”
“আসলে আমার কোন শত্রু আছে এটাই ভাবতে পারছি না।”
“আক্রমণকারীরা ঠিক কি চাইছিল আপনার কাছে?”
“কিছু চায় নি। সরাসরি আক্রমণ করেছে।”
“হাসপাতালে আমি পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
“না অফিসার, এটা আমার ভাল লাগবে না।”
“ঠিক আছে স্যার, আপনার যা মর্জি।”

হঠাr টেবিলের উপর রাখা বন্যার মোবাইলটা কেপেঁ উঠলো। ভাইব্রেশন মুডে দেয়া ছিল। বার দুই কাপার পর থেমে গেল। অনৈতিক তবুও পুলিশের কৌতুহল বলে কথা। সুব্রত কলার এবং তার নাম্বারটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল। পাশের রুম থেকে বন্যা কিছুই বুঝতে পারলো না। অমিতকে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে।

ইন্সপেক্টর সুব্রতকে খুব চিন্তিত মনে হচেছ। একজন বিজ্ঞানী মানুষ পনের বছর পর দেশে ফিরে এসেই আততায়ী হামলার শিকার হবে আর সে কোন প্রোটেকশন পাবেনা সেটা কেমন কথা? কোন দিক থেকেই কোন হদীস করতে পারছে না সুব্রত। তার সামনে অমিতসহ রায় পরিবারের সকল সদস্যের মোবাইল নাম্বার রয়েছে। এর বাইরে দুজন খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষের নাম্বার আছে এরা হলো অঞ্জলী আর ম্যাগী। বিভিন্ন ঘটনায় এই বিদেশী মহিলার সাথে রায় পরিবারের যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে অমিতের সাথে তার একটা গোপন যোগাযোগ আছে সন্দেহ নাই। তার সোর্স যতবার অমিতকে হারিয়ে ফেলেছে ততবারই আগে অথবা পরে ম্যাগীকে তার সাথে দেখা গেছে। এ বিষয়ে মিঃ অমিতকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু এমন একজন সম্মানী মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয় হলে ভাল দেখায় না।

রায় গ্রুপের সকল কোম্পানীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, ইউনিয়ন লীডার, গাড়ি দূর্ঘটনায় আহত কর্মচারী এদের মোবাইল নাম্বারও আছে তার কাছে। সবগুলি নাম্বারের কললিস্ট, সবগুলি মানুষের গতিবিধি এসব পর্যালোচনা করে একটা ছক তৈরী করলো সুব্রত। মেধাবী অফিসার হিসেবে তার খ্যাতি আছে। একটা সুরাহা সে করবেই।

তার আগে অমিতের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা দরকার। সে সাদা পোশাকে দুজন পুলিশকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল। এদের একজন রোগী হিসাবে আর একজন তার এটেন্ডেন্ট হিসাবে হাসপাতালে এল। সকলের অগোচরে তারা অমিতের রুমের প্রতি লক্ষ্য রাখছে। তার একমাত্র ভয় হলো বড় বাবুর ঘুষ খাবার প্রবণতা। যদি কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ এর পেছনে থাকে তবে বড়বাবু নির্ঘাত তাদের কাছ থেকে পয়সা খাবেন এবং সুব্রতকে সঠিক দায়্ত্বি পালন করতে দেবেন না। এজন্য সুব্রত এমন দুজনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে যারা ব্যক্তিগতভাবে সুব্রতর কাছে ঋণী।

বেশ রাত পর্যন্ত মনি শংকর তার অফিসে কাজ করছিল। ম্যাগীও ছিল সেখানে। গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় সে মোবাইল অফ রাখে। ফলে বিন্দু কিছুতেই মনি শংকরকে ধরতে পারছিল না। সে বাধ্য হয়ে তখন পিএকে ধরলো।

ম্যাগী হ্যালো বলতেই বিন্দুর বিদ্রুপাত্মক গলা শুনা গেল, “তুমি আর তোমার বস কি নিয়ে ব্যস্ত শুনি? মোবাইলটাও অফ রেখেছে!”

ম্যাগী শান্ত গলায় জবাব দিল, “আমি ব্যস্ত নই ম্যাডাম। তবে বস ভিতরে কি নিয়ে ব্যস্ত আমি তা জানি না। বলুন আমাকে কি করতে হবে।”

“তুমি দয়া করে তোমার প্রিয় বসকে একটা খবর দাও যে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি অমিতকে এ্টেন্ড করতে।”

“ঠিক আছে ম্যাডাম, আমি স্যারকে জানিয়ে দিচ্ছি। আর যদি কিছু মনে না করেন, আমার একটা অনুরোধ আছে।”

“বল কি বলতে চাও”

“আমার রাতের বেলা তেমন কোন কাজ নেই। আপনি যদি চান আমি অমিত স্যারকে এটেন্ড করতে পারি।”

“তাহলে তোমার বসকে দেখবে কে?”

“অফিস টাইমে বসকে আমিই দেখব। তবে রাতের বেলা সেটা আপনার কাজ।”

“হুম বুলিতো ভালই শিখেছ! বিদ্যে আছে বুঝা যাচ্ছে। তোমার বসকে ফোনটা দাও।”

ম্যাগী মনি শংকরকে ল্যান্ড ফোনের কানেকশন দিল। রেগে উঠতে গিয়ে ওপাশ থেকে বিন্দুর গলা পেয়ে থেমে গেল মনি শংকর। বরং উrকন্ঠা নিয়ে জানতে চাইল, “এনি প্রবলেম?”

“তোমার পি এ টাকে রাতের বেলা একটু ছেড়ে দিলেও তো পার নাকি?”

“ওকে তোমার দরকার?”
“কথার কি ছিরি দেখ, ওকে আমার দরকার হবে কেন, আমার দরকার তোমাকে?”

“হেয়ালী রাখ না প্লীজ। আমি খুব আপসেট আছি। কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বল।”

“মেয়েটাকে বন্যার সাথে অমিতের হাসপাতালে পাঠালে কেমন হয়?”

“কেমন হয় জানি না। ও তো আমার অফিস স্টাফ, পারসোনাল কাজের কথা কেমন করে বলি?”

“পারসোনাল সেক্রেটারী পারসোনাল কাজ করবেনাতো কে করবে শুনি?”

“ঠিক আছে বাবা আমি বলে দেখি। যদি রাজী হয় তবে তুমি নিয়ে গিয়ে বন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও।”

“ঠিক আছে”

মনি শংকর বলতেই ম্যাগী রাজী হয়ে গেল। “নো প্রবলেম স্যার। আমার তো এমনিতেই সময় কাটছে না। তার উপর মিঃ অমিত একজন মার্কিন সিটিজেন। আমারও একটা দায় আছে বৈকি?”

মনি শংকর বিন্দুকে জানাল ম্যাগী রাজী হয়েছে। বিন্দু তখন ম্যাগীকে বাসায় আসতে বলে দিল। তার ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে দুটো কড়া কথা বলে মনের ঝাল মেটাবে। কিন্তু ম্যাগী যখন বাসায় এল দশ মিনিটের মাথায় বিন্দু তার ধারণা পরিবর্তন করলো। বিদেশী মেয়ে মানেই পতিতা নয়। ম্যাগীকে তার ভাল লেগে গেল।হাসপাতালে যাবার আগে ম্যাগীকে সে খেতে দিল। ততক্ষণে বিন্দু ম্যাডাম থেকে মেজ বৌদি হয়ে গেছে। আর বিন্দুর সম্বোধন “হ্যা রে ম্যাগী” তে পৌছে গেছে। ম্যাগী যখন বললো, “মেজ বৌদি তুমিও বসো না।” তখন বিন্দু অবাক হয়ে গেল। বলল, “তুই খা, আমি তোর বসকে নিয়ে খাব।”
“বসকে নিয়ে খাবে না বসকে খাবে?”

ম্যাগীর কথায় বিন্দু লজ্জায় লাল হলো। অবাক হয়ে ম্যাগী ভারতীয় মেয়েদের এই লাস্যময় দিকটা লক্ষ্য করলো। বললো, “তুমি কি জান মেজ বৌদি তুমি কতটা সুন্দর?”

বিন্দু আর ম্যাগীকে ঘাটালো না। ঠোট কাটা মেয়ে । কথা বাড়ালে আরও কত কি বলে বসবে কে জানে?

বিন্দু যখন ম্যাগীকে নিয়ে হাসপাতালে পৌছাল তখন রাত প্রায় নটা। অমিত চোখ বন্ধ করে আছে। বন্যা তার মাথার কাছে চেয়ারে বসে একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। অমিতের শারিরীক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। জ্বর নামছে না। ডাক্তার ইনফেকশন আশংকা করছেন। তাদের ধারনা অপারেশন করে ভাংগা হাড়ের টুকরা সরাতে হবে। আগামী কাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তাদের একটা বোর্ড বসবে। সব জেনে বিন্দুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে ম্যাগীকে বন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, “ও তোমার সাথে রাতে থাকবে। খুব ভাল মেয়ে। আর আমার মোবাইল খোলা থাকবে। যখন খুশী তুমি ফোন দিও।”

“তুমি ভেবো না ছোট মা। সে আমি ঠিক সামলে নেব।”

“নিজের দিকে খেয়াল রাখিস ব্যাটা, তোর পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে।”

“মোটেই না। আমি ঠিক পড়াশুনা করছি। ছেলেটা সেরে উঠলেই আমি সবটা কাভার করে নেব।”

তারা কেউ জানে না, সুব্রতর পুলিশ ছাড়াও আরও দুটি নাইট গ্লাস আলাদা আলাদাভাবে দূর থেকে অমিতের ক্যাবিনে আসা যাওয়া লক্ষ্য করছে।

সকাল বেলা পুজো শেষে অঞ্জলী নাস্তা করতে বসবে এমন সময় গেইট থেকে রামলাল ফোন দিল, ” মা জননী ইনস্পেক্টর সুব্রত বাবু আপনার সাথে দেখা করতে চান।”
“পাঠিয়ে দাও রামু কাকা।”
সুব্রত এসে অঞ্জলীর পা ছুয়ে প্রণাম করলো। তার পর অনুযোগ করে বললো, “আপনি খুব মলিন হয়ে গেছেন মিস্*। এত চিন্তা করার কিছু নেই। অমিত স্যার ভাল হয়ে যাবেন।”
“নাস্তা করেছ ব্যাটা?”
“ইয়েস মিস। তবে আপনার হাতের চা খাব।”

সুব্রতকে বসিয়েই অঞ্জলী নাস্তা সারলো। তার পর চা নিয়ে বসলো দুজন মূখোমূখী। অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে সুব্রত।পচিশ ছাব্বিশ বছর বয়স হবে। পনের বছর বয়সে তার স্কুলের হেড মাস্টার তাকে অঞ্জলীর কাছে নিয়ে আসে। মাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করা ছেলেটি মূহুর্তেই মন কাড়ে অঞ্জলীর। এক সৌম্য দর্শন কিশোর। জগত সংসারে কেউ নেই। অতীব কষ্টে এটুকু পড়াশুনা করেছে। আর এগুতে পারছে না। তার সব দায় নিজ কাধেঁ তুলে নেয় অঞ্জলী। সুব্রত হয়ে যায় আশ্রমের একজন। পড়াশুনা শেষ করে পুলিশে যোগ দেয় সে। অসম্ভব সাহসী, সrআর কর্তব্য পরায়ণ। অঞ্জলী নিজ হাতে তাকে মার্শাল আর্ট শিখিয়েছে। এখন তো সুব্রতর ব্ল্যাক বেল্ট রয়েছে।
“বলো ব্যাটা কেন আমাকে দরকার পড়লো?”
“মিস আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি ভাবে বলবো, তবে না বললেই নয়। মিস ম্যাগী আর অমিত স্যারের সম্পর্ক বা যোগসূত্রটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না।”

“ও আচ্ছা। আসলে অমিত আর ম্যাগী আমেরিকায় একই ফ্লাটে থাকে। তাকে অমিতের সহকারী বা এ ধরণের কিছু বলতে পার। আমার ও প্রথম দিকে ভুল হয়েছিল। মনে করেছিলাম সে বুঝি অমিতের গার্ল ফ্রেন্ড বা ওয়াইফ। পরে ম্যাগী নিজে বিষয়টা আমার কাছে ক্লিয়ার করেছে। অমিতকে অসম্ভব ভালবাসে মেয়েটা। আর সেজন্যই আমেরিকা থেকে এখান অবদি চলে এসেছে।”
“তারা একসাথে হোটেলে ছিলেন।”
“ঠিকই বলেছ। সেটাও আমি জানি। তবে তাদের মাঝে কোন অনৈতিক সম্পর্ক নেই।”
“আপনি যদি বলেন তাহলে অবশ্যই নেই। থাকলেও সেটা আমার মাথা ব্যথার কারণ হতো না। মিস বন্যার সাথে গত রাতে তিনিও হাসপাতালে ছিলেন।”
“আমি জানি।”
“অমিত স্যারের কোম্পানী দুটি এককভাবে রোহিত স্যার ভোগ করছেন। তো এটার আইনগত ভিত্তি কি?”
“অমিতের পাওয়ার অব এটর্নী দেয়া আছে। ঠাকুর মা থাকা অবস্থাতেই এটা করা হয়েছিল অমিত আমেরিকা যাবার আগে।”

“ধরুণ অমিত স্যার আজ মারা গেলেন। তাতে কোম্পানী দুটির কি হবে? বা তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার কে হবেন?”

“অমিতের কোন উইল আছে কিনা আমি জানি না। না থাকলে বিধি মোতাবেক কোম্পানী সকল ভাইবোনের মাঝে ভাগ হয়ে যাবে।”

“আপনার কি ধারণা অমিত স্যার সম্পত্তি বিরোধের শিকার না কোন অপরাধী চক্র এর পেছনে কাজ করছে?”

“বুঝতে পারছি না। দুটোই হতে পারে আবার কোনটাও না হতে পারে।”

“মনি শংকর স্যারের শ্যালক, তথা কথিত সাধুপুরুষ সিধু, তার সম্পর্কে বলেন।”

“তেমন কিছু জানি না। তবে বদ টাইপের লোক। ইউনিয়নের সাথে যোগসাজস আছে। টেরোরিস্টদের সাথেও হাত আছে। কোম্পানীর জন্য ক্ষতিকর।”

“যদি এমন হয় রায় পরিবারের কেউ ফেসে যান, আপনার কি ভুমিকা হবে?”

“অমিতের আততায়ীদের শাস্তি পেতে হবে। সেটা যেই হোক।”
“আপনি সাবধানে থাকবেন। আপনার ডার্ক ব্লু গাড়িটা আইডেন্টিফাইড হয়ে গেছে।”
“শুধু তোমার কাছে না সবার কাছে?”
“আপাততঃ আমার, যে কোন মূহুর্তে অন্যরাও জেনে যাবে।”
“ধন্যবাদ ব্যাটা সতর্ক করার জন্য।”

অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চোখের সামনে নিয়ে খুব তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন আর এম ও মেয়েটার দিকে। তার পর বললেন, “আগে কোথাও কাজ করেছ?”
“মেয়েটা ডানে বামে মাথা নাড়লো।”
“প্র্যাকটিকেল এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া কাজ করা খুব কঠিন।”
“আমি শিখে নেবো স্যার।”
“হুম।
মালিক হলে কত আনাড়িকেই না চাকুরী দেয়া যায়। মনে মনে বিরক্ত হলেও আর এম ও আর কিছু বলার সাহস পেল না। মালিকের আত্মীয় বলে কথা। ডিরেক্টর বাবু তাকে আগেই ফোনে জানিয়েছিলেন তার গ্রামের কোন এক গরীব আত্মীয়ের মেয়েকে নার্সের চাকুরী দিয়েছেন। আজ রাতেই যে কোন সময় আসতে পারে মেয়েটা। আজ থেকেই ডিউটিতে বহাল করে দেয়া ভাল।

সুব্রত চলে যাবার পর অঞ্জলী বেশ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল। সে যে অমিতকে ফলো করছে সেটা সুব্রত জেনে গেছে। তার মানে এখন তাকে অন্য পথ ধরতে হবে। সে হাসপাতালের পরিচালকের নাম্বার খোজেঁ বের করলো। ঠাকুরমার প্রাইভেট সেক্রেটারী হিসাবে অনেক উপরতলার মানুষদের সাথে যোগাযোগ ছিল তার। কৌশলটা ঠাকুরমা শিখিয়েছিলেন। এ পৃথিবীতে কোন কিছুই মাগনা নয়। আজ যার উপকার করছো, লিখে রাখ; সময় সুযোগমত চেয়ে নেবে। এই হাসপাতাল আধুনিকায়নে অর্থ সংকটে ছিলেন মালিক পক্ষ। ঠাকুরমার গ্যারান্টিতে ব্যাংক লোন পায় তারা। বিষয়টা নোট করা আছে অঞ্জলীর কাছে। ফোনে পরিচালককে পেয়েই প্রসংগটা উত্থাপন করলো অঞ্জলী সুকৌশলে। তারপর একটা চাকুরী চাইল নার্সের। আশ্বস্ত করলো এই বলে যে তার নার্সিং প্রশিক্ষণ আছে। কাজ চালাতে কোন সমস্যা হবে না। আশ্রম ছেড়ে নার্সের চাকুরী কেন প্রয়োজন এ প্রশ্নের কোন জবাব অঞ্জলী দিল না। শুধু বললো, “আপনি অপারগ হলে আমি অন্য কোথাও ট্রাই করবো।”
“না না মিস চ্যাটার্জি আমি তা বলিনি। নিশ্চই আপনার কোন প্রয়োজন আছে। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারসহ আপনাকে আর এম ও ‘র কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

সেন্ট্রাল হাসপাতালের নার্স হিসাবে বহাল হয়ে গেল অঞ্জলী। নার্সের পোষাকে দারুণ লাগছে তাকে। মেকাপ নিয়ে মূখের আদলটাকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছে যে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। গলার স্বর পাল্টে ফেলেছে। সামনাসামনি কথা বললেও তাকে চেনা কষ্টকর হবে।

প্রতাপ হাজরাকে দেখেই থানার বড়বাবু অসহায় বোধ করতে লাগলেন।এটা মন্ত্রী মশায়ের চামচা।হেন মন্দ কাজ নেই যা সে করতে পারে না।ছিচকে সিধেল চোর থেকে রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে আজ বেশ হোমড়া-চোমড়া হয়ে পড়েছে।ওর সবচে খারাপ দিক হলো ব্ল্যাক মেইলিং।নানা গোপন তথ্য যোগাড় করে সেটা দিয়ে ব্ল্যাক মেইল করে কাজ আদায় করে।আস্ত একটা হারামীর বাচ্চা।তবে মনে যাই থাকুক, মূখে তার অমায়িক হাসি। “আসুন আসুন প্রতাপ বাবু, তা বলুন কি সেবা করতে পারি?”
“বেশী তেলাবেন না বড় বাবু, প্রতি মাসে আপনাকে মাইনের দশগুণ টাকা আমরা দেই্।তো সে টাকা যোগাড় করতে আমাদেরওতো কিছু কাজ করতে হয় নাকি?”
“আমি ঠিক আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”
“আমার লোকদের পিছনে আপনি বিনা নোটিশে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন।তারা সাতজন লোককে আহত করেছে।তাও আপনি বুঝতে পারছেন না?”
“সত্যি আমি বুঝতে পারছি না প্রতাপ বাবু।আপনার লোকদের তাড়া করার কোন নির্দেশ আমি দিইনি।”
“তা হলে কি আকাশ থেকে পুলিশ এসেছিল?”
“ওয়েট ওয়েট, আমার নতুন একজন অফিসার আছে।রগ ত্যাড়া, দেখি তার কাজ কি না?”

বড় বাবু সুব্রতকে ডেকে পাঠালেন।সুব্রত এসে প্রতাপ হাজরাকে দেখেই যা বুঝার বুঝে নিল। কেউ না জানলেও সুব্রত’র ধারণা অঞ্জলী মিসই অমিতকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু প্রতাপ হাজরার লোকজন ধরে নিয়েছে এটা পুলিশের কাজ। আর বড় বাবুকে যেহেতু নিয়মিত ঘুষ দেয়া হয় তাদের কাজ নির্বিঘ্নে করার জন্য তাই এখন কৈফিয়ত চাইতে এসেছে। সুব্রত এসে স্যালুট করে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বাবু প্রতাপ হাজরাকে দেখিয়ে বললেন, “ইনি প্রতাপ বাবু, মন্ত্রী বাহাদুরের খাস লোক। বড়ই প্রতাপশালী। দিন দুই আগে তাদের কোন লোককে পুলিশ বন পথে আক্রমণ করেছিল। তুমি জান ঘটনাটা?”
“স্যার, আমাকে আর একটু ক্লিয়ার করতে হবে। বুঝতে পারছি না”
এবারে প্রতাপ হাজরা নিজে মূখ খুললেন, “দুই দিন আগে একজন লোকের সাথে আমার কয়েকজন কর্মচারীর বচসা হয়। তখন পুলিশ আমার কর্মচারীদের গুলি করেছে।”
“ভেরী স্যাড স্যার,” সুব্রত ইতোমধ্যে মোবাইল রেকর্ডার চালু করে দিয়েছে, “কার সাথে কি নিয়ে বচসা হয়েছিল স্যার?”
লোকটা এতটাই ডেসপারেট যে থানায় বসে নিজেদের অপরাধ সম্পর্কে কথা বলতে একটুও দ্বিধা করছে না।
“দেখুন, সব বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না। আমি এখানে জবানবন্দি দিতে আসিনি। আমার লোকদেরকে কে এবং কেন গুলি করা হয়েছে আমি জানতে চাইছি।”
“আমিও তো বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করছি প্রতাপ বাবু। সারাদিন চোর-গুন্ডা ঠেংগাই। এর মাঝে কোন ঘটনার কথা বলছেন আমিতো সেটাই বুঝতে পারছি না।”

“আমাদের এক ক্লায়েন্টের প্রতিপক্ষ, নাম অমিত রায়। তাকে আমার ক্লায়েন্টের রাস্তা থেকে সরে যাবার জন্য ভয় দেখাচ্ছিল আমার লোকজন গজারী বনের পথে। সেখানে পুলিশ গুলি করে আমার লোকদের আহত করে।”
“আচ্ছা দাড়ান, দিন দুই আগে গজারী বনের শেষ মাথায় একজন লোককে গাড়ি থেকে নামিয়ে বেদম পেটাচ্ছিল কিছু দুষ্কৃতকারী। দেখে মনে হয়েছিল তাকে মেরে ফেলবে। আমি বাধ্য হয়ে তাকে বাঁচানোর জন্য গুলি ছুড়ি। তারা কি আপনার লোক ছিল?”

“হ্যা আমার লোক ছিল। আমার ট্যাক্সের পয়সায় বেতন খাবেন, আমার গাটের টাকায় ঘুষ খাবেন আবার আমার লোকদের দুষ্কৃতকারী বলে গুলি করবেন এটা কেমন কথা হলো অফিসার?”

সুব্রতর ফর্সা মূখটা রাগে লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু সে জানে এটা মাথা গরমের খেলা নয়। মাথা খাটানোর খেলা। এ ব্যাটা ঘুটি মাত্র। এ কে ব্যবহার করেই তার ক্লায়েন্টের কাছে পৌছাতে হবে। সে অসহায় ভংগী করে বড়বাবুর মূখের দিকে তাকালো। বললো,
“স্যার আমি কেমন করে বুঝবো এরা প্রতাপ বাবুর লোক। আমাকে আগে থেকে কেউ ইনফরম করেনি।”
বড় বাবু সুযোগটা লুফে নিলেন। বললেন, “দেখুন প্রতাপ বাবু, যা হয়েছে তা একটা ভুল বুঝাবুঝি মাত্র। আপনারা ক্ষমতার কাছাকাছি লোক। দেশের জনগণের মংগলের জন্য কাজ করতে গিয়ে কোথাও যদি আপনারা একটু কঠোর হন তো সেটা আমাদের আগে থেকে ইনফরম করা দরকার। আপনি সুব্রতকে আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিন। কারণ আমি মাঠে থাকি না। মাঠ দাবড়ে বেড়ায় সুব্রত।”
“ঠিক আছে অফিসার এর পর আর যেন এরকম ঘটনা না ঘটে।”

সুব্রত সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো। প্রতাপ বাবু তার গোপন কন্টাক্ট নাম্বার সুব্রতকে দিয়ে বিদায় নিল। যাবার আগে বড়সড় দুটো বান্ডেল রেখে গেল টেবিলের উপর। সুব্রত লোভী চোখে তাকিয়ে রইল টাকাগুলির দিকে। বড় বাবু বুঝলেন আদর্শের ভুত নেমে গেছে সুব্রতর মাথা থেকে। তিনি একটা বান্ডিল ছুড়ে দিলেন সুব্রতর দিকে। সুব্রত এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্তর্পনে পকেট থেকে রুমাল বের করে ঢেকে ফেলল বান্ডিলটা। তারপর রুমালসমেত চালান করে দিল ইউনিফর্মের পকেটে।

নিজের রুমে ফিরে মোবাইলে রেকর্ড করা সব কথা কপি করলো ল্যাপটপে। পাসওয়ার্ড দিয়ে সেইভ করলো। ফাইলটা এটাচ করলো তার একটা ই-মেইল এ। সেটা সেন্ড করলো তারই ভিন্ন একটা ই-মেইল একাউন্টে। তারপর মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিল ফাইলটা। প্রতাপ হাজরার কন্টাক্ট নাম্বার রেখে দিল মগজে। তার পর ব্যাংকে গিয়ে রুমালসহ টাকার বান্ডিলটা রেখে এল সেফটি লকারে।
তিন তিনটে সূতা এখন তার হাতে । মনটা ফুরফুরে। গানের একটা কলি গুণ গুণ করতে করতে বেরিয়ে এল চেম্বার ছেড়ে।

0 comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...